হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী:
প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। আল্লাহ পাক বলেন, আপনি বলে দিন আল্লাহ পাকের ফজল ও রহমতের জন্য তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে (সুরা ইউনূস-৫৮)। এখানে আল্লাহর রহমত মূলত তার হাবিব হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কেননা আল্লাহ পাক বলেন, আমি আপনাকে সারা জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি (সুরা আম্বিয়া-১০৭)।
বিশেষ করে অসহায় উম্মতের রহমত এবং শেষ আশ্রয়স্থল। দরদী নবী সমগ্র জীবন উম্মতের কল্যাণ কামনায় কাটিয়েছেন। উম্মতকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য তিনি সারা জীবন মেহনত করেছেন।সর্বাবস্থায় সর্বস্থানে শুধু এ চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন যে, কীভাবে সকল উম্মত ঈমানদার হয়ে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি পায়।
নবীজি যে কতো দরদী ছিলেন কোরআনে কারিমে সে ব্যাপারে আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এসেছেন তোমাদের মধ্যকার এমন একজন রাসুল, তোমাদের দুঃখ যার কাছে দুঃসহ। তিনি তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী, বিশ্বাসীদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সূরা তওবা : ১২৮)।
হযরত ইবনে আস (রা.) বর্ণনা করেন একদিন রাসুল (সা.) কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বারবার বলতে লাগলেন ‘আল্লাহুম্মা উম্মতি উম্মতি’ এ অবস্থা দেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ.) এসে যখন নবীজিকে কারণ জিজ্ঞেস করলেন তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন ‘আমি আমার উম্মতের মাগফিরাত চাই’। (সহিহ মুসলিম)।
রাসুল (সা.)-এর মুবারক জীবন পর্যালোচনা করলে মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা সমৃদ্ধ মহাসমুদ্রের গভীরতা অনুমান করা যায়; তবে নির্ণয় করা যায় না। রাসুল (সা.) যে কতো দয়ালু তা অনুভব করার জন্য কোরআনে পাক, সিরাত এবং হাদিসে পাকের সাগরে ডুব দিতে হবে। প্রিয় নবী যতদিন ইহজগতে ছিলেন ততদিন উম্মতের দুঃখ কষ্টে বিচলিত হতেন।
অসহায় উম্মতেরা যখন কোথায়ও আশ্রয় খুঁজে পেত না তখন নবী (সা.)-ই ছিলেন তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। দয়াল নবীর আশ্রয়ে যে সব সাহাবিরা সব সময় থাকতেন, তারা হলেন আসহাবে সুফফা!মসজিদে নববীর সংলগ্ন একটি কক্ষে সার্বক্ষণিক ৭০ জন সাহাবি অবস্থান করে প্রতি মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস মুবারক সমূহ মুখস্থ করতেন, এই ৭০ জন সাহাবির জীবন যাত্রার ব্যয়ভার প্রিয় নবীর আশ্রয়েই সংগ্রহ হতো। শুধু ইহ জগতে নয় বরং কিয়ামত পর্যন্ত এমনকি পরজগতেও দয়াল নবী উম্মতের শেষ আশ্রয়স্থল।হজরত আলী (রা.) বলেন, আমরা যখন রাসুল (সা.)-এর দাফনকার্য সম্পাদন করছিলাম তখন এক বেদুঈন এসে নবীজীর (সা.) কবরে আছড়ে পড়ল এবং নিজ মাথায় মাটি নিক্ষেপ করতে করতে বলতে লাগল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.), আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘যদি তারা নিজেদের ওপর জুলুম করে অতঃপর আপনার কাছে এসে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে আল্লাহ তাদের অপরাধ মার্জনা করবেন (সূরা নিসা : ৬৪)। এখন আমি আপনার দরবারে এই উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু আপনি তো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আমি কোথায় যাব? তখন কবর থেকে আওয়াজ এলো- ‘যাও তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে’।
হজরত আলী (রা.) বলেন, ওই আওয়াজ উপস্থিত সবাই শুনতে পেয়েছিল। [শাওয়াহেদুন নবুয়ত, মদিনা পাবলিকেশন্স পৃ. ১৪৩-১৪৪] এবং তাফসিরে ইবনে কাসিরে আছে ‘আতবি’ নামক সাহাবিকে স্বপ্নযোগে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলে দিয়েছিলেন যে, সেই ব্যক্তিকে সু-সংবাদ দাও ‘তাকে মাফ করা হয়েছে’।আল্লাহর নবী প্রতিনিয়ত উম্মতের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে যাচ্ছেন। ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত প্রিয় নবীকে (সা.) সাহাবীরা যখন জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি ইহজগৎ থেকে চলে গেলে আমাদের কী হবে? আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন ‘হায়াতি খাইরুল্লাকুম, ওয়া ওফাতি খাইরুল্লাকুম’ অর্থাৎ আমার ইহকালীন জীবন যেমনি আল্লাহর পক্ষ হতে আমার উম্মতের জন্য কল্যাণকর, তেমনি আমার ওফাত এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়াও আল্লাহর পক্ষ হতে আমার উম্মতের জন্য কল্যাণকর ।কারণ আমার উম্মতের আমলনামা যখন আমার সামনে উপস্থাপন করা হবে তখন উত্তম আমল দেখলে আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব এবং খারাপ আমল দেখলে আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব! (ফাতহুল কাবির, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৬৮ হাদিস নং ৫৮৮৭)। শুধু তাই নয়! কাল হাশরে যখন অসহায় উম্মত নৈরাশ্যের মধ্যে পড়ে আশ্রয়হীন হয়ে আশ্রয় খুঁজতে থাকবে তখন দয়াল নবীজিই হবেন গোনাহগার উম্মতের শেষ আশ্রয়স্থল, উম্মতদের উদ্ধারে সেদিন দয়াল নবী এগিয়ে আসবেন।
হযরত আনাস (রা.) বলেন আমি রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলাম, হাশরের দিন আপনাকে কোথায় তালাশ করবো? তিনি (সা.) তিন স্থানের কথা বললেন (১) পুলসিরাতের নিকট (২) মীযানের নিকট (৩) হাওযে কাওসারের নিকট । (মিশকাত, শাফা’আত অধ্যায়)।হজরত আনাস (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন যখন আমার উম্মত আটকা পড়বে, তখন আমি হব তাদের সুপারিশকারী। যখন তারা নিরাশ হয়ে পড়বে, তখন আমি হব তাদের সুসংবাদদাতা। সম্মান ও কল্যাণের চাবি সেদিন আমার হাতে থাকবে। (তিরমিযি ও দারেমি)। উম্মতেরা যখন হাশরের মাঠে অস্থির হয়ে উঠবে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন নবীদের দরবারে যাবে এবং এক-এক করে সবাই ফিরিয়ে দিবে তখন শেষ আশ্রয় হিসাবে শাফিউল মুযনিবীন মুহাম্মদ (সা.)-এর খেদমতে হাযির হয়ে শাফা’আত (আশ্রয়) খুঁজবে, তখন রাসুল (সা.) বলবেন এটা আমারই কাজ।একথা বলেই তিনি সিজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কাঁদতে থাকবেন। তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন ‘হে আমার হাবীব! আপনি মাথা উঠান এবং বলুন, আপনি সুপারিশ করুন, কবুল করা হবে। আপনি যা চাইবেন আপনাকে তা-ই দেয়া হবে। (বুখারী-মুসলিম)।
কোরআনে কারিম ও হাদিসে মুবারাকার আলোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, উভয় জগতেই দয়াল নবীজি হলেন উম্মতের শেষ আশ্রয়স্থল। প্রিয় নবী বলেন: সকল নবীকেই মহান আল্লাহ দুটি দুআ চেয়ে নেবার অধিকার দিয়েছেন। তারা সবাই ইহজগতে চেয়ে নিয়েছেন!? কিন্তু আমি সে দুআ সযতেœ রক্ষা করে চলেছি। শেষ বিচারের দিনে আমি তা কাজে লাগাবো। ঈমানের সাথে যারা দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে, আমি তাদের আশ্রয়স্থল হবো অর্থাৎ তাদের শাফা’আত করবো।
কোরআনে কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ‘আপনার পালনকর্তা আপনাকে এত প্রাচুর্য দিবেন যে, আপনি সন্তুষ্ট হবেন (দুহা, ৯৩:৫)। এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর প্রিয় নবী (সা.) বললেন: ততক্ষণ পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট হব না যতক্ষণ পর্যন্ত আমার অসহায় উম্মতের একটি লোকও জাহান্নামে থাকবে। (কুরতুবী)।আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন যেন আমাদের সকলকে উপরোক্ত আলোচনার প্রতি আমল করার তাওফিক দান করেন আমীন।তথ্যসূত্র: ১. তাফসিরে মাযহারি ২. তাফসিরে ইবনে কাসির ৩. মারেফুল কোরআন ৪. ফাতহুল কাবির ৫. বুখারি শরিফ ৬. শাওয়াহেদুন নবুয়ত, ইমাম আব্দুর রহমান জামী।