ঠাকুরগাঁওয়ে ৮ মামলায় ২ হাজার ৫শত আসামি, গ্রেফতারের আতঙ্কে ঘর ছাড়া

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি :

দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় টানা ক্ষমতায় থেকে গেলো ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ তাঁর দাপুটে মন্ত্রী-এমপিরা। বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে বিরোধী দল ও সাধারণ জনতাকে হামলা, মামলায় জর্জরিত করে রাখা হতো। তবে, পট পরিবর্তনেই সারাদেশে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একের পর ১ মামলা দায়ের হচ্ছে।

সারাদেশের মতো ঠাকুরগাঁও জেলায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যা সহ একাধিক মামলা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সরকার পতনের ২ মাসে বিদায়ী সরকারের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র আন্দোলনে নিহত-আহত ও বোমা হামলার ঘটনায় ৮ টি মামলা রুজু হয়েছে। এর মধ্যে ভাঙচুর ও আন্দোলনে হত্যার চেষ্টা ও হাসিনা পতনের দিন অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৪ জন নিহতের ঘটনায় মামলাও হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ৩ জন সাবেক সংসদ সসদ্য ও পৌসসভার মেয়রকে গ্রেফতার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। পরে আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। বাকি আসামিদের আটকের জন্য চলছে পুলিশের অভিযান। গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা।

এদিকে ঢালাও মামলায় শুধু আওয়ামী দলীয় লোকজনই নয়, মামলাগুলোর কয়েকটিতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই এমন ব্যক্তিবর্গ, বিএনপি সমর্থক ও ব্যবসায়ীর নাম দেওয়া হয়েছে বলে, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। বিশেষ করে ওয়ার্ড যুবদলের প্রচার সম্পাদক শ্রী দেবদাস ঘনার নামে মামলা হওয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম নিয়েছে দলের ভিতরে-বাইরে। আগস্টে পুলিশি কার্যক্রম শুরুর পর থেকে গত ১৬ আগস্ট পর্যন্ত এই মামলাগুলো হয়েছে।

এসব মামলায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নিহতের ঘটনায় আগস্টে ৩টি, সেপ্টেম্বরে ৩টি এবং অক্টোম্বরে ২টি। ২টা মামলায় আবার বিএনপি কয়েকজন নেতাকর্মী কেউ আসামি করা হয়েছেন। যদিও মামলার বাদীরা বলছেন, ভুল করে অনেকের নাম মামলায় দেওয়া হয়েছে আর কেউ কেউ বলছেন আসামীদের তাঁরা চিনেই না। ৮ মামলায় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রায় ৫০০ জনেরও বেশির নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ২ হাজার। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সবশেষে ১ জুলাই আন্দোলনে নামেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা।

পরবর্তী সেই আন্দোলনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মী আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক হামলা চালানো শুরু করে। এক পর্যায়ে ১৫ জুলাইয়ের পর থেকে দেশব্যাপী গণহত্যায় নামেন আওয়ামী লীগ। আন্দোলনে দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে ঠাকুরগাঁও জেলায় ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হাজারো ছাত্র-জনতা গুলি বৃদ্ধ হয়ে আহতের তথ্য মিলেছে। টানা ৩৬ দিনের তীব্র আন্দোলনে শতশত ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে নতুন করে স্বাধীনতার মুখ দেখেন দেশের মানুষেরা।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দেন। আর সেদিন বিকালেই বিক্ষুব্ধ জনতা ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপনায় হামলা চালিয়ে লুটপাট করে। বেশকদিন পুলিশি সেবা থেকে বঞ্চিত হন জনসাধারণ। পরবর্তীতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনায় থানা পুলিশের কার্যক্রম চালু হলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যার শিকার হওয়াদের পরিবারের সদস্যরা একের পর এক মামলা দায়ের করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট, গুরুত্বর জখম, ভয়ভীতি ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার মামলাগুলোর মধ্যে বিদায়ী সরকার প্রধান শেখ হাসিনার এমপি রমেশ চন্দ্র সেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলাম সুজন, ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার ও ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান রিপন, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অরুনাংশ দত্ত টিটো, ঠাকুরগাঁও জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল মজিদ আপেল, সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত সমীর, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারুল ইসলাম সরকার, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন, ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষেদের চেয়ারম্যান সহ জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ মামলার প্রধান আসামি রমেশ চন্দ্র সেন, অরুনাংশ দত্ত টিটো, আব্দুল মজিদ আপেল ও দেবাশীষ দত্ত সমীরকে করা হয়েছে। অন্যদিকে মামলার বাদীর আইনজীবীকে তা বাদী মাহাবুব হোসেন নিজেই জানেন না।

আর কিভাবে এজাহারে ৮৫ জনের নাম এলো তাও তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। একমাত্র ইউপি চেয়ারম্যান ছাড়া কাউকেই চেনেন না বাদী। বাদীর ভাষ্যমতে, অচেনা কয়েকজন সমন্বয়ক পরিচয়ে বাড়ি থেকে ডেকে এনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও নাম দেখিয়ে এজাহারে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরবর্তীতে কিভাবে ৮৫ জনের নাম এলো খোদ তিনি নিজেই জানেন না। এমনকি স্থানীয় যুবদলের ওয়ার্ড প্রচার সম্পাদকের নাম থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি নিজেই।

আরেক বাদী শামীম ইসলাম (সিফান) জানান, অনেকের নাম ভুল করে মামলায় দেয়া হয়েছে। পরে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু যাদের নামগুলো দিয়েছি, তাদের আমি চিনি না। তা সংশোধন করা হবে।

এখন পর্যন্ত রুজু হওয়া মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও সদর থানার নবাগত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, আমি সদ্য জয়েন করেছি থানায়। আমাদের নিয়মিত সকল পুলিশিং কার্যক্রম চালু রয়েছে। আশা করছি আর অল্প সময়ের মধ্যেই সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারবো।

হত্যা মামলা সহ অন্যান্য মামলার আসামিদের গ্রেফতারের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতি শীঘ্রই আসামিদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযানে নামবো। সকল আসামিকে গ্রেফতার করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *