হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী:
আল্লাহর রাসূলের প্রতি মুহাব্বাতই ঈমানের মূল,কারো সঙ্গে মুহাব্বত হওয়া এবং সেই মুহাব্বতের কারণে তাঁর অনুগত হওয়া সাধারণত:তিনটি কারণে হয়ে থাকে। প্রথমত: তাঁর কোন বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কারণে মুহাব্বত হয় যেমন কোন আলেম ও বীরপুরুষের সংগে মুহাব্বত হয়। দ্বিতীয়ত: রূপ ও সৌন্দর্য্যের কারণে মুহাব্বত হয় যেমন কোন সুন্দর মানুষের সঙ্গে মুহাব্বত হয়। তৃতীয়ত: কোন কৃপা ও করুণা লাভের কারণেও মুহাব্বত হয়।
হযরত মুহাম্মদ (স:) এর মহান জীবন এই তিন প্রকারে বৈশিষ্ট্যই পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে। মুহাব্বত বা ভালবাসার সকল প্রকার উপকরণই যখন মহানবী এর মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে তাই তাঁর সঙ্গে উম্মতের মহব্বত পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া অনিবার্য। এ ব্যাপারে শরীয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে অনেক। তবুও স্বভাব ও বিবেচনার সঙ্গে ধর্মীয় চেতনা একত্রিত হয়ে হযরত মুহাম্মদ (স:) এর সাথে মুহাব্বত এবং ভালবাসাকে ওয়াজেব ও অনিবার্য করে দিত। একথা সন্দেহাতীতরূপে বলা চলে যে, এই সমস্ত কারণে মহানবী এর সংগে মুহাব্বত হওয়ার পর তার অনুসরণ থেকে বিরত থাকা, অসম্ভব, অকল্পনীয়। মহানবী সা. এর সংগে যার ভালবাসার যত বেশী হবে, তাঁর প্রতি ভক্তি ও আনুগত্যও তত বেশী।
বলাবাহুল্য হযরত রসূলে করীম (স:) এর সংগে ভালবাসা স্থাপন করা পরিপূর্ণরূপে ফরজ। প্রিয়নবী এরশাদ করেছেন ”তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পরাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান-সন্ততি এবং সকল মানবজাতির মধ্যে সব চেয়ে প্রিয় না হই (বুখারী, মুসলিম)।
ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত উমর (রাঃ) আরজ করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ (স:) আপনি আমার নিকট সকল বস্তুর চেয়ে সর্বাধিক প্রিয়। তবে আমার প্রাণ আমার নিকট অধিক প্রিয়। প্রিয়নবী এরশাদ; করলেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার প্রাণের চেয়েও বেশী প্রিয় না হই। হযরত উমর (রাঃ) তখন বললেন: সেই মহান সত্তার শপথ, যিনি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছেন, আপনি আমার প্রাণের চেয়ে আমার নিকট অধিকতর প্রিয়। মহানবী সা. এরশাদ করলেন হাঁ এখন ঈমান অধিক ও পরিপূর্ণ হয়েছে। হযরত উমর (রাঃ) প্রত্যেক মহব্বতকে পরোক্ষ মহব্বত থেকে অধিক দৃঢ় মনে করে প্রথমে নিজের প্রাণকে অধিক প্রিয় বলেছিলেন।
একই বিষয় মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এরশাদ করছেন এভাবে- বলুন, (হে নবী আপনি বলে দিন) যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসায় মন্দা দেখার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর, এসব যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তবে আল্লাহর ফয়সালা না আসা পর্যন্ত তোমরা অপেক্ষা কর, আল্লাহ কখনও ফাসেকদের (সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে) সৎপথের সন্ধান দেন না। (সূরা তওবা : ২৪)
হযরত রসূলে করীম (স:) এরশাদ করলেন:যে আমার অনুকরণ বা মহান আদর্শকে ভালবাসে, সে আমাকে ভালবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে আমার সাথে বেহেশতে থাকবে। (তিরমিজী ও মিশকাত)
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স:) কে ভালবাসা প্রত্যেক ব্যক্তির মুমিন হওয়ার পূর্বশর্ত। তবে শুধু বিশ্বনবীকে ভালবাসলে তাঁর প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না বরং আরো আরো দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। কারণ তাঁকে মুহাব্বত করার পাশাপাশি তাঁর সুন্নতকেও অনুসরণ করতে হবে, পালন করতে হবে।
অনেকেই আছে যারা কেবল মুখে বিশ্বনবীর প্রশংসা করেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ করে। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে না, অনুসরণের চেষ্টাও করে না। এরাও পূর্ণ ঈমানদার নয় যারা বিশ্বনবীর সুন্নতের উপর আমল না করে। কারণ বিশ্বনবীর মর্যাদা ও তাঁর শান ও শওকত এটা আমরা তখনই বুঝতে পারব যখন তাঁর সুন্নতের পাবন্দ হব।
বিশ্বনবীর সুন্নতের অনুসারী না হলে কোনোভাবেই তাঁর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। তবে আফসোস আজকাল তাঁর নাম স্মরণকারী অনেক আছে, কিন্তু সে তুলনায় তাঁর উসওয়াতুল হাসানাহ অনুসরণকারী লোকের সংখ্যা খুবই কম। যদি আপনি মুখে দাড়ি রাখলেন না, নিয়মিত জামাতের সাথে নামায পড়েন না, প্যান্ট-পায়জামা টাখনুর নিচে পরিধান করেন, লোকদের সাথে দেখা সাক্ষাত হলে সালাম দেন না, তাহলে এখনই সাবধান হয়ে যান। কারণ আপনার এই জীবন প্রিয়নবীর সুন্নাত মোতাবেক নয়। এইজন্য বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.কে মুহাব্বতও করতে হবে এবং তাঁর সুন্নতের অনুসরণও করতে হবে।
হযরত রাসূলুল্লাহ (স:) কে যেমন ভালবাসতে হবে তেমনি তাঁর নির্দেশনাগুলো নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাঁর প্রতিটি হুকুমকে কাজে পরিণত করতে হবে। বর্তমান ফিতনার যুগে হযরত রাসূলে আকরাম সা. এর সুন্নত বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন কাজ। এইজন্য প্রিয়নবী এই ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ (স:) এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি ফাসাদের যুগে আমার সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে অঁকড়ে ধরবে তার জন্য একশত শহীদের সওয়াব রয়েছে। (মেশকাত)
এই হাদীসে সুন্নাত জিন্দা করার এত গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে কারণ সুন্নতকে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শহীদদের চেয়েও অধিক শ্রমসাধ্য। কারণ শহীদ এক মুহূর্তে মহান আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। কিন্তু সুন্নাত পালনকারী বেচারা প্রতি মুহূর্তে সমাজের নানা প্রতিকূল অবস্থার স্বীকার হয়। এইজন্য তো প্রিয়নবী এরকম সুসংবাদ দান করেছেন। যে ব্যক্তি যাকে ভালবাসে সে তাঁর প্রতিটি কাজকেই পছন্দ করে। ঠিক তেমনি যে একজন একনিষ্ঠ আশেকে রাসূল তার দৃষ্টিতে প্রিয়নবীর প্রতিটি কাজই সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য।
হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত , এক ব্যাক্তি আবেদন করলেন , ইয়া রাসুলাল্লাহ! কেয়ামত কখন হবে ? উত্তরে আল্লাহর রাসুল জিজ্ঞেস করলেন । কিয়ামতের জন্য তুমি কি প্রস্তুতি নিয়েছ ? লোকটি আরয করলো , আমি তেমন কোন প্রস্তুতি নিতে পারিনি ; তবে আমি আল্লাহ এবং তাঁর প্রিয় রাসুল কে ভালবাসি। এবার হুজুর এরশাদ করলেন , তুমি যাকে ভালবাস কিয়ামত দিবসে তুমি তার সাথেই থাকবে । (এ হাদিসের বর্ণনাকারী ) হযরত আনাস (রা) বলেন,“ইসলামের আবির্ভাবের পরে আমি মুসলমানদেরকে এরূপ আর খুশি হতে দেখিনি, যে রুপ এ কথাটুকু শুনে খুশি হয়েছেন ।” ( বুখারী )
হযরত রাসূলুল্লাহ (স:) এর প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন – বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভালবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ্ও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ্ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। (সূরা আলে-ইমরান : ৩১)
সুবহানাল্লাহ কি সৌন্দর্য ইসলামের। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার ও তাঁর নৈকট্য লাভের পথ হচ্ছে তাঁর হাবীবকে অনুসরণ ও মুহাব্বাত। এই জিনিসটিকেই আল্লামা ইকবাল তাঁর কবিতার মাধ্যমে কি সুন্দরভাবে বর্ণনা করছেন।” কি মুহাম্মদ সে ওয়াফা তু নে, তু হাম তেরে হ্যায়, ইয়ে জাহা ছিইজ হ্যায় কিয়া, লওহে কলম তেরে হ্যায়। ” অর্থাৎ” মুহাম্মদ সা. রাসূলে নিবেদিত হও, খোদার খোদায়ি দু’জাহান তোমরই নিবেদিত হবে।