জুমআর দিনের ইবাদতে যেসব ফজিলত ও মর্যাদা পাবে মুমিন

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী:

সপ্তাহের সেরা দিন শুক্রবার তথা জুমআর দিন। এটি দুনিয়ার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিন। জুমআ নামে পবিত্র কুরআনে জুমআ নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা নাজিল করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘অতপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর ও আল্লাহকে অধিকরূপে স্মরণ কর; যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমআ : আয়াত ১০)

জুমআর নামাজ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নামাজ। جُمُعَة (জুমু’আহ) শব্দটি আরবি। এর অর্থ একত্রিত হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া।

যেহেতু সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন শুক্রবার প্রাপ্তবয়স্ক মুমিন-মুসলমান নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত একটি স্থানে একত্রিত হয়ে জামাআতের সঙ্গে জোহরের পরিবর্তে নামাজ আদায় করে। ইসলামে এ নামাজই জুমআর নামাজ হিসেবে পরিচিত।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার উপর সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো জুমআর দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাকে জান্নাতে স্থান দেয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাকে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।’ (মুসলিম)

জুমআর দিনের ইবাদত ও আমলের গুরুত্ব অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা এ দিনেই জগৎ সৃষ্টির পূর্ণতা দান করেছিলেন। মুসলিম উম্মাহ সাপ্তাহিক ইবাদত উপলক্ষে মসজিদে একত্রিত হয় বলে এ দিনকে ইয়াওমুল জুমআ বা জুমআর দিন বলা হয়।

জুমআ ফরজ:
প্রথম হিজরিতে জুমআর নামাজ ফরজ হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে কুবা নামক স্থানে অবস্থান শেষে শুক্রবার দিন মদিনায় পৌঁছেন এবং বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে জোহরের ওয়াক্ত হলে সেখানেই তিনি জুমআর নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমআর নামাজ।

জুমআর দিনের ফজিলত:
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন ফরজ গোসলের মত গোসল করে প্রথম দিকে মসজিদে হাজির হয়, সে যেন একটি উট কুরবানি করল, দ্বিতীয় সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন একটি গরু কুরবানি করল, তৃতীয় সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি ছাগল কুরবানি করল। অতপর চতুর্থ সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে গেল সে যেন একটি মুরগি কুরবানি করল। আর পঞ্চম সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি ডিম কুরবানি করল। অতপর ইমাম যখন বেরিয়ে এসে মিম্বরে বসে গেলেন খোতবার জন্য, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খোতবা শুনতে বসে যায়।’ (বুখারি)

অন্য হাদিসে ১০ দিনের গোনাহ মাফের ঘোষণা এসেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভালভাবে পবিত্র হলো অতপর মসজিদে এলো, মনোযোগ দিয়ে খোতবা শুনতে চুপচাপ বসে রইল, তার জন্য দুই জুমআর মধ্যবর্তী এ সাত দিনের সঙ্গে আরও তিনদিন যোগ করে মোট দশ দিনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে খুতবার সময় যে ব্যক্তি পাথর, নুড়িকণা বা অন্য কিছু নাড়াচাড়া করল সে যেন অনর্থক কাজ করল।’ (মুসলিম)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘জুমআর নামাজে তিন ধরনের লোক হাজির হয়। তারা হলো-

  • যারা মসজিদে প্রবেশের পর তামাশা করে, তারা বিনিময়ে তামাশা ছাড়া কিছুই পাবে না।
  • যারা জুমআয় হাজির হয়, সেখানে দোয়া মুনাজাত করে, ফলে আল্লাহ যাকে চান তাকে কিছু দেন আর যাকে ইচ্ছা দেন না।
  • যারা জুমআয় হাজির হয়, চুপচাপ থাকে, মনোযোগ দিয়ে খোতবা শোনে, কারো ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে আগায় না, কাউকে কষ্ট দেয় না, তার দুই জুমআর মধ্যবর্তী ৭ দিনসহ আরও তিনদিন যোগ করে মোট দশ দিনের গুনাহ খাতা আল্লাহ তাআলা মাফ করে দেন।’ (আবু দাউদ)

জুমআর নামাজ আদায়ের প্রতি পদক্ষেপে এক বছরের নফল রোজা ও এক বছরের সারারাত তাহাজ্জুদ পড়ার সওয়াব অর্জিত হয়। যে ব্যক্তি আদব রক্ষা করে জুমআর নামাজ আদায় করে তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে তার জন্য পুরো এক বছরের রোজা পালন এবং রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ার সওয়াব লেখা হয়। হাদিসে এসেছে-

হজরত আউস বিন আউস আস সাকাফী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমআর দিন যে ব্যক্তি গোসল করায় (অর্থাৎ সহবাস করে, ফলে স্ত্রী ফরজ গোসল করে এবং) নিজেও ফরজ গোসল করে, আগে আগে মসজিদে গমন করে এবং নিজেও প্রথম ভাগে মসজিদে গমন করে, পায়ে হেঁটে মসজিদে যায় (অর্থাৎ কোনো কিছুতে আরোহণ করে নয়), ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসে, মনোযোগ দিয়ে খোতবা শোনে, কোনো কিছু নিয়ে খেল তামাশা করে না; সে ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য রয়েছে বছরব্যাপী রোজা পালন ও সারা বছর রাত জেগে ইবাদত করার সমতুল্য সওয়াব।’ (মুসনাদে আহমাদ)

গোনাহের কাফফারা জুমআ:
জুমআর নামাজ দুই জুমআর মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহের কাফফারা হয়ে যায়। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পাঁচ বেলা নামাজ আদায়, এক জুমআ থেকে পরবর্তী জুমআ, এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজানের মধ্যবর্তী সময়ে হয়ে যাওয়া সব (সগিরা) গোনাহের কাফফারা স্বরূপ, এই শর্তে যে, বান্দা কবিরা গোনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে।’ (মুসলিম)

জুমআর দিনে দোয়া কবুল:
জুমআর ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো- এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমআর দিনে এমন একটা সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাঁকে তা দান করবেন।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, আস্-সুনানুল কুবরা)

হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমআর দিনের কাঙ্ক্ষিত সময়টা হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা, তিরমিজি)

জুমআর দিনের আমল:
জুমআর দিনে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমল। হাদিসে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো হলো-

  • গোসল করা।
  • ফজরের ফরজ নামাজে সুরা সাজদা ও সুরা দাহর/ইনসান তেলাওয়াত করা।
  • উত্তম পোশাক পরা।
  • সুগন্ধি ব্যবহার করা।
  • আগেভাগে মসজিদে যাওয়া।
  • সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা।
  • মসজিদে গিয়ে কমপক্ষে দুই রাকাআত সুন্নত নামাজ আদায় করা।
  • ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসা।
  • মনযোগ দিয়ে খোতবা শোনা।
  • খোতবা চলাকালে কোনো কথা না বলা।
  • দুই খোতবার মাঝের সময়ে বেশি বেশি দোয়া করা। অন্য সময়ে দোয়া করা। কারণ এদিন দোয়া কবুল হয়।
  • রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর সারাদিন যথাসম্ভব বেশি দরূদ পাঠ করা।

সুতরাং জুমআর দিন দেরি না করে হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী জুমআ আদায়ে প্রস্তুত গ্রহণ করাই মুমিন মুসলমানের অন্যতম কাজ। আল্লাহ তাআলা জুমআ আদায়ে মুসলিম উম্মাহকে তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *